শনিবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:৫৫ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

সেতু নিয়ে নাদানপনা কী বার্তা দেবে

উম্মুল ওয়ারা সুইটি:
প্রমত্তা পদ্মার দুই পাড় মিলেছে। হাজার বছরের কষ্টের অবসান হয়েছে দক্ষিণ-পশ্চিমের ২১ জেলার। আরও নির্দিষ্ট করে বললে ১৯ জেলার যোগাযোগব্যবস্থায় নতুর যুগের সূচনা হয়েছে। দেশের এত বড় একটি অঞ্চলের যখন যোগাযোগব্যবস্থায় মাইলফলক পরিবর্তন ঘটে, তখন আর এর অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিষয়টি বলার অপেক্ষা রাখে না। দেশের নিজস্ব অর্থায়নে এত বড় একটি কাজ সম্পাদন আগামী প্রজন্মের শক্তি-সামর্থ্য আর সাহসের যাত্রাকে সহজ করে দিয়েছে। সেই সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের মতো সংস্থাগুলোর কাছে এটি বিশেষ বার্তা হয়ে থাকল।

সিলেটসহ দেশের বেশ কিছু এলাকায় বন্যা চলছিল। বলা যায় মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে। ঠিক তার আগেই পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আড়ম্বর আয়োজন শুরু হয়। পদ্মা সেতু আয়োজন বড়ই হওয়া উচিত। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অসম্ভব সব বাধা পেরিয়ে এই সেতুর কাজ যে শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বে শেষ হয়েছে এটা জমকালো অনুষ্ঠান ছাড়া দুনিয়ায় জানান দেওয়া সম্ভব হতো না। পদ্মা সেতু নিয়ে বাংলাদেশের ভেতর থেকেই ভূরি ভূরি গুজবের খবর বেরিয়েছে। বন্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একদল নেমে গেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, সেতু উদ্বোধন একেবারেই সাদামাটা করে টাকাটা যেন বন্যার্তদের দেওয়া হয়। কী যে আকুতি। মনে হলো একটা পক্ষ বোধ হয় এবার জুঁতসই একটা যুক্তি খুঁজে পেল। মানুষকে আগে বাঁচাতে হবে। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনে সব আয়োজন বন্ধ করে সেই টাকা নিয়ে মাঠে নামতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানবতার ঝড় উঠে যায়। মনে হচ্ছিল না খেয়ে না দেয়ে এই মানুষগুলো সুনামগঞ্জের বন্যাকবলিত এলাকায় হাবুডুবু খাচ্ছে। বন্যাকবলিত মানুষদের মাথায় তুলে রাখছে। এক্ষেত্রে আমার মনে হয়েছে, দেশের মানুষগুলোর এখন সাধারণ চিন্তার বিকাশ প্রয়োজন। আর দেশের ভালো কিছুর প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থনের জন্য তাদের মানসিকতা তৈরি করা উচিত। এখানে হতাশা আসে তরুণ প্রজন্মের প্রতি। তবে এই হতাশার কেন্দ্রে আমরাই। কোথায় যেন আগামীর কা-ারি এই তরুণদের লালন-পালনে বড় একটা ফাঁকি রয়ে যাচ্ছে। তাদের মাথার মগজগুলো আমরা আস্ত রেখে নিজেদের মতো করে তাদের ওপর আমাদের বুড়ো কুচিন্তা আর জড়তা ঢুকিয়ে দিচ্ছি। বাচ্চারা আর নিজের মগজ নিয়ে খেলা করে না। শুধুই গুগল, টিকটক আর ফেইসবুক। শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমই নয়। সেতুর উদ্বোধনের আগে নাশকতারও চেষ্টা হয়েছে। আমরা খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যেই জেনেছি উদ্বোধনকে নস্যাৎ করতে নানাভাবে নাশকতার চেষ্টা করা হয়েছে। এই ষড়যন্ত্রকারীদের মূল সংখ্যা কমই হবে। কিন্তু তারা সক্রিয় এবং তরুণ প্রজন্মকে এই সব কাজে ব্যবহার করছে। যাই হোক, পদ্মা সেতুর পরিকল্পনা থেকে শুরু করে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত যে ষড়যন্ত্র, তা মোকাবিলা করে গত ২৫ জুন চমৎকার উজ্জ্বল এক আয়োজন দেখল বিশ্ব। যদি খুব ভুল না হয়, বড় আয়োজনের মধ্যে সরকারের ব্যবস্থাপনায় এত সুশৃঙ্খল এবং সুন্দর আয়োজন আর দেখেনি কেউ। মঞ্চসজ্জা থেকে শুরু করে জাজিরার সমাবেশস্থল, তারপর প্রধানমন্ত্রী চলে যাওয়ার পরও উচ্ছ্বসিত মানুষের আবেগের যে বন্যা তা বেশ ভালোভাবেই সামাল দিয়েছেন দায়িত্বপ্রাপ্তরা। আয়োজনকদের ধন্যবাদ দিতেই হয় এত সুশৃঙ্খল স্নিগ্ধ পরিবেশ তৈরি করার জন্য। সকাল ১০টা থেকে মাওয়া প্রান্ত থেকে জাজিরা পর্যন্ত চারটি ইভেন্ট হয়েছে। বাহুল্য নেই শুধুই আনন্দ আর আনন্দ। সকাল ১০টা বাজতে ৫ মিনিটের আগেই সাহসিকা, যার দৃঢ় এবং সুপরিকল্পনা এই অসাধ্য সাধন হয়েছে তিনি এলেন, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উদ্দীপনা শেখ হাসিনা। মাওয়া প্রান্তে সকাল ৯টার আগেই এসে উপস্থিত হয়েছেন, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, দেশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, কূটনীতিক, মন্ত্রী ও সরকারের আমলারা এসেছেন। উদ্বোধনে ইতিহাসের সাক্ষী হতে মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে এসেছেন লাখো মানুষ। কেউ এসেছেন নিজের চোখে শেখ হাসিনাকে দেখতে। আবেগে কেঁদেছে বাঙালি মন। এদিন ১৭ কোটি মানুষের ৩৪ কোটি চোখ টেলিভিশনে।

সেতু যেমন মন ভরিয়েছে, তেমনি আয়োজন ছিল অল্প সময়ের কিন্তু যুগ যুগ মনে রাখার মতো। সুশীল সমাজের সামনে ও জাজিরার সমাবেশে শেখ হাসিনা এই অর্জন যখন জনগণের কাঁধে তুলে দিলেন দেশে আপামর মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন সহযোগিতার জন্য, ঠিক সেই সময়ে মাওয়া প্রান্তে অপেক্ষমাণ মানুষের চোখে আনন্দজল গড়িয়ে পড়তে দেখেছি। হাত তুলে আল্লাহর কাছে শেখ হাসিনার জন্য দোয়া করতে দেখেছি। শেখ হাসিনা জাজিরা ও সুশীল সমাজের সমাবেশ দুই স্থানেই বক্তৃতায় সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সাবেক যোগাযোগ সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া ও প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির অভিযোগে সৈয়দ আবুল হোসেনের মন্ত্রিত্ব হারানো, মোশাররফ হোসেনের কারাবরণ এসব অপবাদের কথা ভোলেননি প্রধানমন্ত্রী। সেতুর সুইচ টিপে দক্ষিণ দুয়ার খোলার আগেই এই তিনজনকে পাশে নিয়েছেন। জাজিরাও গিয়েছেন তাদের নিয়েই। মাঝে পদ্মা সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে যখন বিমানবাহিনীর বিমান ও হেলিকপ্টারের মনোজ্ঞ ‘ফ্লাইং ডিসপ্লে’দেখছিলেন তখনো এই তিনজন তার পাশে ছিলেন। কন্যা মনোবিজ্ঞানী সায়মা ওয়াজেদ পুতুলও তার সঙ্গে ছিলেন। এসময় পদ্মার আকাশ নীলের সঙ্গে হেলিকপ্টার থেকে প্রক্ষেপিত বর্ণিল ছটায় অন্যরকম রূপ নেয়। সমালোচনার শিকার এই তিনজনকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সেতু উদ্বোধন সবাইকে মনে করিয়ে দেয়, যারা ত্যাগ করে তাদের প্রতি সম্মান দেখাতে একটুও পিছপা নন সরকারপ্রধান।

যাই হোক। দুপুর ২টায় প্রধানমন্ত্রী ও বিশেষ অতিথিরা চলে যাওয়ার পর সেতু উন্মুক্ত ছিল আমন্ত্রিতদের জন্য। দুপুর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত যানবাহনবিহীন সেতুর ওপর সেলফি, আড্ডা আর লাইভ চলছিল। সেই সঙ্গে সংবাদমাধ্যমগুলোতেও এই আনন্দ ছিল সবার উপভোগ্য। সংবাদ সংগ্রহের সুবাদেই সংবাদকর্মীরা বেশি সময় ছিলেন এবং অনেকেই নিজেদের ফেইসবুক পেইজ থেকে লাইভ করেছেন। পরদিন মানে ২৬ জুন সেতু সবার জন্য খুলে দেওয়া হবে। আগের দিন দূর থেকে দেখার উত্তেজনা যেন ধরে রাখতে পারছে না অনেকেই। ২৬ জুন ভোর ৬টায় টোল প্লাজা খোলা হবে। কে কার আগে যাবে তাই নিয়ে প্রতিযোগিতা। এটাই হওয়ার কথা। সেতু কর্র্তৃপক্ষও মানুষের এই আবেগের প্রতি শ্রদ্ধাই দেখিয়েছে। এই সেতুর ওপর দিয়ে একবার যেতে কার না মন চাইবে। পরিবার, স্বজন ও বন্ধুবান্ধব নিয়ে কেউ এসেছেন প্রাইভেট কারে, মাইক্রোবাস ভাড়া করে, পিকআপ ভ্যানে আর বেশিরভাগ তরুণ এসেছেন মোটরবাইকে। মাত্র আট ঘণ্টায় ৮৩ লাখ টাকা টোল। আর ২০ ঘণ্টায় ২ কোটি পার। এটা তো আনন্দের দিক। মানুষের আবেগকে মূল্য দিয়েছে সেতু কর্র্তৃপক্ষ। সেতুতে দাঁড়িয়ে সেলফি তোলা, পরিবারসুদ্ধ সেতুতে হেঁটে বেড়ানো। কোনোটিতেই বড় বাধা ছিল না। কিন্তু উৎসুক মানুষের অতিরঞ্জন বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রশ্রয় দিলে আমরা যে নিজেদের সীমা ধরে রাখতে পারি না, তাই প্রমাণিত হয়েছে। সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে টিকটক করতে গিয়ে নাটবল্টু খুলেছে কেউ। বিশৃঙ্খল বেপরোয়াভাবে মোটরসাইকেল রেসে দুই তরুণের প্রাণ গেছে। অথচ এদিন অন্ততপক্ষে চারশতাধিক মোটরবাইক সেতু দিয়ে পার হয়েছে। দুজনের মৃত্যুর পর উপায়ান্তর না দেখে কর্র্তৃপক্ষ ২৭ জুন ভোর ৬টা থেকেই সেতুর ওপর দিয়ে মোটরবাইক চলাচল বন্ধ করে দেয় এবং সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে সেলফি তোলা বা পার্কিং করার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করে।

উৎসুক মানুষগুলো যদি তাদের পরিমিতিবোধ ধরে রাখতে পারত তাহলে অনেকেই এই শিথিল সুযোগ নিতে পারত। কিছু মানুষের অস্থিরতা আর অসৌজন্য আচরণের খেসারত দিতে হচ্ছে সবাইকে। সেতু তো খুলেই দেওয়া হয়েছে। এই পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, কেউ যদি আমাদের আকাশের চাঁদটা এনে দেয় কিছুদিনের জন্য, সেই চাঁদ আমরা ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে ফেলব। আশপাশের দেশসহ বিশ্বমিডিয়া যখন পদ্মা সেতু আয়োজন নিয়ে চোখ রাখছে এই নাদানপনা কী ম্যাসেজ দেবে বাংলাদেশের মানুষ সম্পর্কে। এখন রয়েসয়ে খাওয়ার শিক্ষা দেওয়ার সময় এসেছে।

লেখক : সাংবাদিক

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION